মরুদেশেই ইদের চাঁদ |   মুসব্বাররা বিদেশেই

দেবনীল সরকারঃ রমজানের চাঁদ দেখে দ্বিতীয় রোজার দিন ঘর ছেড়ে ছিল মুসব্বার সেখ। পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে পারি দিয়েছেন সৌদি আরব। কার্পেন্টারের কাজের জন্য গত ডিসেম্বরে মুম্বাইয়ে ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছেন মুসাব্বার। সেই কাজে সিলেকশনের খবর এসেছে দুমাস আগে। তবে থেকেই তোড়জোড় শুরু। শেষে রমজানের চাঁদ দেখে মুম্বাইয়ের হাজী আলী বন্দরের দিকে রওনা দেন মুসাব্বার। সেখান থেকে পারি দেন সৌদি আরবে। কিন্তু সেখানে পৌঁছে কী অবস্থার মুখোমুখি হলেন মুসাব্বার? তা উঠে এল মুসব্বারের বাবা মায়ের বয়ানে। দূর মরুদেশে ইদ কাটাবে বাড়ির ছোট ছেলে। তাঁর কথা ভেবে চোখ চিকচিক করে উঠল মুসাব্বারের মায়ের।

যদিও ছেলের সাথে নিয়ম করে কথা হচ্ছে ভিডিও কলে। তবুও মায়ের মন পরে আছে ধূধূ মরুভূমির দেশে। কারপেন্টারের কাজের অ্যাপোয়েন্টমেন্ট নিয়ে প্রায় এক লক্ষ তিরিশ হাজার টাকা খরচ করে সৌদি গেছেন ছোট ছেলে। কিন্তু করতে হচ্ছে ক্লিনিং বা ঘর সাফাইয়ের কাজ। মন খারাপ ছেলেরও, বাবা মাকে ফোনে সে কথা জানিয়েছেন মুসাব্বার। কিন্তু নিরুপায় সেখ পরিবার। ছেলে যে কোম্পানির চুক্তিতে ভিটে ছেড়েছেন সেই কোম্পানি থেকে অন্য কোম্পানিতে হাত বদল হয়ে গিয়েছেন তিনি, তাঁর অজান্তে। আজ প্রায় ১৫ দিন থেকে সেই কাজ নিয়ে অনিশ্চিতের মুখোমুখি জেলার এই তরুণ।  দুঃশ্চিন্তায়  ঘুম উড়েছে তাঁর বাপ মায়ের।

মুসাব্বার সেখের বাবা মা

নিয়াল্লিশপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতের বহড়া গ্রামের ছেলে মুসাব্বার সেখ। ২৩ বছরের এই তরুণ কাজের তাগিদে ঘর ছাড়া। ইচ্ছে না থাকলেও আরব মুলুকে কাটাতে হবে ইদ। মুসাব্বারের বাবা মীরাজুল সেখ পেশায় চাষি। তিন ছেলে তাঁর। কালের নিয়মে বড়, মেজো ছেলে সবাই বিদেশ খেটে এসেছেন একবার করে। কেউ পাঁচ কেউ বা সাত বছর বিদেশ খেটে এসে করেছেন পাকা বাড়ি, কাঠের কারখানা। এবার পালা ছোট ছেলে মুসাব্বারের। চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে ঘর ছেড়েছেন মুসাব্বার। শুধু মুসাব্বারই নয়, বহড়া গ্রামের প্রায় সব পরিবারেরই কেউ, কোনও না কোনও সময় সৌদি আরব গিয়েছেন পরিযায়ী শ্রমিক হিসাবে। এই গ্রামের তরুণদের বিদেশে খাটতে যাওয়ার প্রবণতা ৪০ শতাংশের এর বেশি। দিন দিন সংখ্যাটা বাড়ছেই। শুধু বহড়া কেন? মুর্শিদাবাদের অধিকাংশ সংখ্যালঘু অধ্যুষিত গ্রামীণ পঞ্চায়েতে এই সংখ্যার খুব একটা তারতম্য দেখা যায় না।

হাসানুজ্জামাল সেখ ভিডিও কলে কথা বলছেন ভিনদেশে থাকা ভাইয়ের সাথে

গ্রাম থেকে গ্রামে মূলত যে তরুণদল পরিযায়ী শ্রমিক হিসেবে সৌদি আরবে যায় তাঁদের বেতন সর্বনিম্ন সাতশো থেকে সর্বোচ্চ তিন হাজার সৌদি রিয়াল ( ১ রিয়াল = প্রায় ২২ টাকা) পর্যন্ত হয়ে থাকে। ভারতীয় মুদ্রায় সংখ্যাটা বেশ বড় তবে এই মোটা অঙ্কের বেতনের কাজ করতে গিয়ে ভিন দেশে গিয়ে অনেকেই ভয়ংকর অবস্থার মুখোমুখি হন। সব ক্ষেত্রে যে শুধুই সমস্যা, তা অবশ্য নয়। তবে কিছু ক্ষেত্রে জটিল সমস্যার মুখে পড়তে হয় বৈকি।  এই যেমন মুসাব্বার। চুক্তি হয়েছিল এক কাজের , আ  র  করতে হচ্ছে অন্য আর এক কাজ। আরবের যে শহরে কাজ করার কথা সেখান থেকে প্রায় ৩০০০ কিলোমিটার দূরে ২০ ঘন্টার বাস সফরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ধূধূ মরুভূমির মাঝে এক জায়গায়। ১৮০০ সৌদি রিয়াল বেতনে কাজ করার কথা থাকলেও পাচ্ছেন ১১০০ করে।। থাকার জায়গা দিয়েছে বটে। তবে যে ছেলে কাঠের কাজে আরব গিয়েছিল সেখানে গিয়ে ঘর সাফাইয়ের কাজ করে, নিজের খাবার নিজে বানিয়ে খুব কষ্ট করে দিন গুজরান করছেন মুসাব্বার। পরিবারও নিরুপায়। সেখ পরিবারের ছোট ছেলে ইদ কাটাবে ওই মুলুকেই। ইদ মিটলে এই নিয়ে লোকাল এজেন্টের সাথে কথা বলবেন মুসাব্বারের আব্বা। তবে তাতে কি হবে সমস্যার সমাধান!

 

বহড়া গ্রামের এসব চেনা ছবি,বলে দাবি করলেন সাত বছর আরবে খেটে আসা পরিযায়ী শ্রমিক হাসানুজ্জামাল সেখ। প্রায় সাত বছর আরব    ‘গালফ্ ক্যাটারিং নামক একটি সংস্থার সাথে কাজ করেছেন হাসান। তাঁর বয়ানে উঠে এল সেখানকার কাজের অবস্থা। হাসান বলেন, গ্রাম থেকে ছেলেপুলেরা কাজের আশায় বিদেশ যায়। যেমন আমি গিয়েছিলাম। আমি যেখানে কাজে গেছিলাম, তাঁদের সাথে আমার বাড়ির মতো সম্পর্ক হয়ে গিয়েছিল। যেকোনও অসুবিধায় সবাইকে পাশে পেতাম। কিন্তু সবার কপাল ভালো হয়না। দিনকাল বদলাচ্ছে। কাজ করতে গিয়ে অসুবিধায় পরতে হচ্ছে বহু ছেলেকে। হাসানের ভাই আমির সোহেল আরবের দামমাম প্রদেশে গিয়েছেন রঙের কাজ করতে, প্রায়   ছ’মাস আগে। ওখানে পৌঁছে গেলেও নেই কাজ, পাচ্ছেন না বেতনও। যে কোম্পানির হয়ে গিয়েছিলেন, নাকচ করতে বসেছে সেই কোম্পানিও। গিয়ে থেকে বসেই আছেন আমির। ধার করে, আর নিজের সঞ্চয় থেকে চলছে কোনও রকমে, কিন্তু এভাবে আর কদিন? হয়তো ফিরে আসতে হবে আমিরকে। কিন্তু সেও কি মুখের কথা! লাখ খানেক টাকা খরচ করে গিয়েছেন, এবার ফিরে এলে সমস্যার সমাধান হবে নাকি সমস্যা বাড়বে ভেবেই দিশেহারা দাদা হাসান।

 

তবে ক্যালেন্ডার মেনে ইদ এসেছে । উৎসবে মেতেছে  সারা বিশ্ব এরই মাঝে অন্ধকার ঘরে নুডুলস খেয়ে ইদ পালন করছেন  কেউ। এটা তাঁদের কষ্ট নয়, অধ্যায়ন। হয়তো দিন বদলাবে, সেই আশাতেই  আরব মুলুকে বসে ইদের নামাজ পড়বেন জেলার এই তরুণদল। অন্ধকার কেটে যাবে। ফুটবে আলো। নুডুলস হবে বিরিয়ানি। মুখে হাসি ফুটবে তাঁদের বাবা মায়ের মুখেও। ইদ আসবে ইদ যাবে। আর এইভাবেই নিজেদের দেখা স্বপ্ন সফল করার লক্ষ নিয়ে মরুভূমি পেরিয়ে এগিয়ে চলবে বাকি মুসাব্বারেরা ।